কান্তজীর মন্দির । অবস্থান, ইতিহাস এবং কেন বিখ্যাত

ভূমিকাঃ কান্তজীর মন্দির । অবস্থান, ইতিহাস  এবং কেন বিখ্যাত

কান্তজীর মন্দির, বাংলাদেশে যত পুরনো মন্দির রয়েছে সেগুলোর মধ্যে  অন্যতম। প্রাচীন এই মন্দিরটির বয়স প্রায় ৩০০ বছর। বিভিন্ন নামে এর পরিচিতি আছে, যার মধ্যে আছে কান্তজীউ মন্দির, কান্তনগর মন্দির, নবরত্ন মন্দির ইত্যাদি। উত্তরবঙ্গের দিনাজপুর জেলার কান্তজীর মন্দির অবস্থিত।


স্থাপত্যিক  রীতিগঠন  বিন্যাস,  শিল্পচাতুর্য  কান্তজীর  মন্দিরের  সামগ্রিক  দৃশ্যকে  এতই  মাধুর্যমণ্ডিত করে   তুলেছে যে এর চেয়ে সুন্দরনয়নাভিরাম মন্দির বাংলাদেশে দ্বিতীয়টি নেই।

কান্তজীর মন্দির এর অবস্থান

 কান্তজীর মন্দির দিনাজপুর শহর থেকে ২০ কিলোমিটার উত্তরে এবং কাহারোল উপজেলা সদর থেকে সাত কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে সুন্দরপুর ইউনিয়নে্র কান্তনগর গ্রামে ঢেঁপা নদীর তীরে  কান্তজীর মন্দির অবস্থিত। দিনাজপুর-তেঁতুলিয়া মহাসড়কের পশ্চিমে এর অবস্থান।

কান্তজীর মন্দির এর নামকরণ

কান্তজীর মন্দির হিন্দু দেবতা শ্রীকৃষ্ণের জন্য স্থাপিত মন্দির। কালিয়াকান্ত জীউ অর্থাৎ শ্রী-কৃষ্ণের বিগ্রহ স্থাপনের জন্যই মন্দিরের নামকরণ হয়েছে কান্তজীউ এর মন্দির, যা থেকে লোকমুখে নাম পরিবর্তন হয়ে হয়েছে কান্তজী বা কান্তজীর মন্দির। মন্দিরটির সুবাদে এলাকাটি কান্তনগর নামে পরিচিতি পায়। সেজন্য পরবর্তী সময়ে এর আরেক নাম হয়ে যায় কান্তনগরের মন্দির। এটি 'নবরত্ন মন্দির' নামেও পরিচিত কারণ তিনতলা বিশিষ্ট এই মন্দিরের শীর্ষে নয়টি চূড়া বা রত্ন ছিল। ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দের ভূমিকম্পে এই  চূড়াগুলি ধ্বংস হওয়ার আগে  জন হেনরি এর ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে তোলা একটি ছবিতে মন্দিরের নয়টি রত্ন বা চুড়া দেখা যায়

                               নবরত্ন বা চূড়া বিশিষ্ট কান্তজীর মন্দির। ছবি উৎসঃ  Wikipedia.org

কান্তজীর মন্দির এর ইতিহাস

কান্তজীর মন্দির এর উত্তর দিকের ভিত্তিবেদীতে স্থাপিত শিলালিপি্র বর্ণনা অনুযায়ী, তৎকালীন দিনাজপুরের জমিদার মহারাজা  প্রাণনাথ রায়  মন্দিরের নির্মাণকাজ শুরু করেন। তিনি ১৭২২ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন । এরপর প্রাণনাথের পোষ্যপুত্র মহারাজা রামনাথ রায় ১৭৫২ খ্রিষ্টাব্দে নির্মাণকাজ শেষ করেন। জনশ্রুতি আছে, স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে  শ্রী-কৃষ্ণের বিগ্রহ অধিষ্ঠানের জন্য কান্তজীর মন্দির নির্মিত হয়েছিল
শুরুতে চূড়া সহ মন্দিরের চূড়ার উচ্চতা ছিল ৭০ ফুট।

 
১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে কান্তজীর মন্দিরের চূড়াগুলো ভেঙে যায়। বর্তমানে মন্দিরের উচ্চতা ৫০ ফুট। পরে মহারাজা গিরিজানাথ মন্দিরের ব্যাপক সংস্কার করলেও মন্দিরের চূড়াগুলো আর সংস্কার করা হয়নি। 
১৯৬০ সালে সরকারের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন বিভাগ এই কান্তজীর মন্দিরকে প্রাচীন কীর্তি হিসেবে ঘোষণা করে এবং এর সংস্কারের দায়িত্ব নেয়। তখন থেকে কান্তজীর মন্দির প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগ কতৃক সংরক্ষিত এবং রক্ষণাবেক্ষণ হয়ে আসছে।

কান্তজীর মন্দির কেন বিখ্যাত

কান্তজীর মন্দির  বিখ্যাত এর অভাবনীয় সৌন্দর্য এবং অতুলনীয় শিল্পকর্মের জন্য। কান্তজীর মন্দির প্রাঙ্গণ আয়তাকার।  পাথরের ভিত্তির উপরে দাঁড়ানো ৫০ ফুট উচ্চতার মন্দিরটি বর্গাকার। তিনতলায় নির্মিত এই মন্দিরের গঠনশৈলী স্থাপত্যকলার অনন্য নিদর্শন। নিচতলার সব প্রবেশপথে বহু খাঁজযুক্ত খিলান রয়েছে। দুটো ইটের স্তম্ভ দিয়ে খিলানগুলো আলাদা করা হয়েছে, স্তম্ভ দুটো খুবই সুন্দর এবং সমৃদ্ধ অলংকরণযুক্ত। কান্তজীর মন্দিরের পশ্চিম দিকের দ্বিতীয় বারান্দা থেকে সিঁড়ি উপরের দিকে উঠে গেছে। মন্দিরের নিচতলায় ২১টি এবং দ্বিতীয় তলায় ২৭টি দরজা-খিলান রয়েছে, তবে তৃতীয় তলায় রয়েছে মাত্র ৩টি করে।
তবে কান্তজীর মন্দিরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলো সারাদেহে বসানো পোড়ামাটির ফলক বা টেরাকোটার অনিন্দ্যসুন্দর কারুকার্য। প্রায় ১৫০০০ এর মতো টেরাকোটা বা পোড়ামাটির ফলকসমৃদ্ধ এই কান্তজীর মন্দির ছিল অবিভক্ত বাংলার সবথেকে সুন্দর মন্দির। 
কান্তজীর মন্দিরের গায়ে লাগানো পোড়ামাটির ফলক বেশ উৎকৃষ্ট মানের যা সমসাময়িক অন্য কোনো দালানে দেখা যায় না। 
তবে পোড়ামাটির ফলকগুলোর বিশেষত্ব আসলে অন্যখানে। এগুলো সাধারণ কোনো টেরাকোটার কাজ নয়। এর গায়ে লাগানো প্রত্যেকটা ফলকে রামায়ণ ও মহাভারতের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। তবে কিছু ফলকে মুঘল আমলের চিত্রবর্ণনাও দেখা যায়। তবে এসব ফলকের উপস্থাপন ছিল অনন্য যা অন্যান্য টেরাকোটার নিদর্শনে দেখা যায় না। কান্তজীর মন্দিরের স্তম্ভের কার্ণিশে সে সময়ের জীবন ও অভিজাত শ্রেণির শিকার করার দৃশ্য চিত্রায়িত হয়েছে।

দ্বিতীয় ধাপে রয়েছে মুঘল জীবন ব্যবস্থার প্রতিচ্ছবি। এ ধাপে মুঘল বাদশাহদের শিকার ও কারুকার্য খচিত বাহনের দৃশ্যায়ন দেখা যায় । তৃতীয় ধাপে রয়েছে পৌরাণিক কাহিনী বর্ণনা। রামায়ণ ও মহাভারতের বিভিন্ন কাহিনী দেখানো হয়েছে এখানে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ, সীতার বনবাস, বকাসুর হত্যা ইত্যাদি  গুরুত্বপূর্ণ পৌরাণিক কাহিনী স্থানর হয়েছে এই ধাপে।

আরও পড়ুনঃ পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার । কোথায় অবস্থিত এবং কেন বিখ্যাত

 তবে এই ধাপের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ভগবান শ্রীকৃষ্ণের লৌকিক উপস্থাপন। শ্রীকৃষ্ণের কাহিনী সমূহকে এখানে জনসাধারণের জীবনের মতো চিত্রায়িত করা হয়েছে। মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে পৌরাণিক গল্পকথা। পৌরাণিক কাহিনীর সাধারণ মানুষের মত  উপস্থাপনে তাই কারিগরদের সৃষ্টিশীলতা ও দক্ষতার এক অনন্য নিদর্শন টেরাকোটাগুলো।

কান্তজীর মন্দির আরও বিখ্যাত এখানে হওয়া রাসমেলার জন্য।

কান্তজীর মন্দির বিখ্যাত হবার আরেকটি কারণ এর কাছাকাছি অবস্থিত ঐতিহাসিক নয়াবাদ মসজিদ।  কান্তজীর মন্দির নির্মাণের জন্য ভারত থেকে আগত মুসলমান স্থপতিরা নিজেদের ইবাদতের জন্য এই মসজিদ নির্মাণ করেন। এখানেও মধ্যযুগীয় নির্মাণশৈলী এবং সুদৃশ্য টেরাকোটার দেখা পাওয়া যায়।

শেষ কথা । কান্তজীর মন্দির । অবস্থান, ইতিহাস  এবং কেন বিখ্যাত

আমাদের আজকের আর্টিকেল পড়ে আশা করি কান্তজীর মন্দির সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারলেন। এমন আরো নিত্যনতুন তথ্য ও আর্টিকেল জানতে আমাদের সাইট নিয়মিত ভিজিট করুন। আর কোন মতামত থাকলে জানান কমেন্ট সেকশনে।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url

এইটা একটি বিজ্ঞাপন এরিয়া। সিরিয়ালঃ ১

এইটা একটি বিজ্ঞাপন এরিয়া। সিরিয়ালঃ ২

এইটা একটি বিজ্ঞাপন এরিয়া। সিরিয়ালঃ ৩

এইটা একটি বিজ্ঞাপন এরিয়া। সিরিয়ালঃ ৪