জমজম কূপ । জমজম কূপের ইতিহাস, গুরুত্ব এবং উপকারিতা

পরিচিতিঃ জমজম কূপ । জমজম কূপের ইতিহাস, গুরুত্ব এবং উপকারিতা

জমজম কূপ পৃথিবীতে আল্লাহ তাআলার এক বিস্ময়কর নিদর্শনের নাম। পৃথিবীর সকল মুসলিমদের কাছে অন্যতম গুরুত্বপুর্ণ এক স্থানে হচ্ছে এই জমজম কূপ।   পবিত্রতা, প্রাণময়তা ও বৈশিষ্ট্যে জমজম কূপের পানি পৃথিবীর সকল পানির চেয়ে উত্তম। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, 'ভূপৃষ্ঠের সবচেয়ে উৎকৃষ্ট ও কল্যাণকর পানি জমজমের পানি। এ পানি ক্ষুধার্তের জন্য খাদ্য এবং রোগির জন্য শেফাস্বরুপ।' (ইবনে মাজাহ)
জমজম কূপ (আরবি ভাষায়: "زمزم"‎) হল সৌদি আরবের মক্কায় মসজিদুল হারামের ভেতরে অবস্থিত একটি পানির কুয়া। এটি কাবা ঘর থেকে প্রায় ১৯ মিটার পূর্বে অবস্থিত। 

জমজম কূপের ইতিহাস

পৃথিবীর  অন্যতম প্রাচীন এবং অদ্যবধি চালু থাকা পানির কূপের একটি হচ্ছে জমজম কূপ।  প্রায়  পাঁচ হাজার   বছর  ধরে এখান  থেকে একটানা পানি পাওয়া  যাচ্ছেএকারণে জমজম কূপকে     বিশ্বের    প্রাচীনতম   সক্রিয়   কূপ  মনে  করা  হয় ( বুখারি ৩৩৬৪, সাঈদ ইবনে জুবাইর (রাঃহতে বর্ণিত)।
জমজম কূপের ৎপত্তিঃ
     জমজম কূপের ৎপত্তির সময় তখন ছিলো হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর নবুয়তকাল। মহান আল্লাহ একের পর এক কঠিন পরীক্ষা নিচ্ছেন তাঁর, আর ইবরাহিম (আ.)-ও খুব সফলতার সঙ্গে উত্তীর্ণ হচ্ছেন। হজরত ইসমাইল (আ.)-এর জন্মের কিছুদিন পর আরেকটি শক্ত পরীক্ষার মুখোমুখি হলেন ইবরাহিম (আ.)। 
আল্লাহর তরফ থেকে নির্দেশ আসে, প্রিয় সন্তান ও স্ত্রী হাজেরা (আ.)-কে মক্কার জনশূন্য মক্কার ফারান পাহাড়ের পাদদেশে নির্বাসন দেয়ার। আল্লাহর নির্দেশ পালনে তিনি তাদেরকে আরবের সেই জনশূন্য প্রান্তরে নিয়ে গেলেন। মক্কা তখন ধু ধু মরীচিকাময় এক ভীতিপ্রদ উপত্যকা। তাদের সেখানে রেখে ফিরে যাবার সময় হজরত ইবরাহিম (আ.) আল্লাহর কাছে দুয়া করলেন,
"হে আমার রব, আমি আমার বংশধরকে ঊষর উপত্যকায় তোমার ঘরের কাছে বসবাস করালাম;যাতে তারা নামাজ কায়েম করে। সুতরাং কিছু লোকের হৃদয়কে তাদের প্রতি অনুরাগি করে দাও এবং তাদের জীবিকার ব্যাবস্থা করে দাও, যাতে তারা কৃতজ্ঞ থাকে" - (সূরা ইবরাহিম - ৩৭) ।
 এমন অঞ্চলে বাস করা একা একজন নারীর জন্য খুব কষ্টসাধ্য ব্যাপার ছিলো। তপ্ত মরুভূমিতে একসময় মা হাজেরা ও শিশু ইসমাইলের খাদ্য ও পানীয় শেষ হয়ে যায়। এক ফোঁটা পানির আশায় এদিক-সেদিক দৌড়াদৌড়ি করতে লাগলেন। সাফা পাহাড়ের মরীচিকাকে পানির নহর মনে করে দৌড়ে গেলেন সেখানে। কিন্তু দেখলেন, তপ্ত বালুকাময় প্রান্তর ছাড়া কিছুই নেই। একই আশা নিয়ে সেখান থেকে দৌড়ে গেলেন মারওয়া পাহাড়ে, সেখানেও পানি নেই। 
এভাবে সাফা থেকে মারওয়া এবং মারওয়া থেকে সাফায় সাতবার দৌড়াদৌড়ি করেন। দৌড়াদৌড়ির সপ্তম বা শেষ বার তিনি লক্ষ্য করলেন, শিশু ইসমাইলের পায়ের নিচে তার পায়ের আঘাতে গর্ত হয়ে পানির ফোয়ারা বয়ে যাচ্ছে। অন্য আরেক বর্ণনা অনুযায়ী ফেরেশতা হজরত জিবরাইল (আঃ) এর পা অথবা ডানার আঘাতে জমজম কূপের ৎপত্তি।  
জমজম কূপের নামকরণঃ
হাজেরা (আ.) জমজম কূপের পানিকে থামার নির্দেশ দিয়ে হিব্রু ভাষায় উচ্চৈঃস্বরে বলছিলেন ‘জমজম’ অর্থাৎ থেমে যাও। আল্লাহর ইচ্ছায় তা নির্দিষ্ট স্থানে থেমে গেলো। হজরত হাজেরা(আঃ) উচ্চারিত সেই হিব্রু শব্দ থেকেই এ কূপের নাম হয়ে যায় ‘জমজম কূপ’। য়াবার কিছু আরব ইতিহাসবিদের মতে, "জমজম" শব্দের অর্থ অধিক হওয়া বা আধিক্য। এখানে পানির আধিক্যর কারনে নাম হয়েছে জমজম কূপ। 
জমজম কূপের খনন ও সংস্কারঃ

পানির সুবিধা দেখে ইয়েমেনের জুরহাম গোত্রের কিছু লোক সেখানে বসতি স্থাপন করলেন। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই জনমানবহীন মরুপ্রান্তর রূপ নিলো জনবসতিতে। ইসমাইল (.) বড় হয়ে এই গোত্রে বিয়ে করেন। তাঁরাই কাবা ঘরের খাদেম হন। পৌত্তলিক যুগে জুরহাম গোত্র মক্কা থেকে বিতাড়িত হয়। ক্ষমতা দখল করে খোজায়া গোত্র। 

আরও পড়ুনঃ বৈঠক শেষে দোয়া ও ইসলামিক বক্তব্য শুরুর দোয়া

চলে যাওয়ার আগে জুরহাম গোত্রের লোকেরা কুয়াটি মাটি দিয়ে ভরাট করে দেয়। সাড়ে ৪০০ বছর এভাবেই পড়ে থাকে জমজম কূপ। ৫৭০ সালে আবদুল মুত্তালিব ্স্বপ্নে জমজম কূপের অবস্থান জানতে পারেন এবং ছেলে হারেসকে সঙ্গে নিয়ে জমজম কূপের পূনঃ খনন করেন।  

পরবর্তিতে জমজম কূপের একাধিক বার সংস্কার ও খনন কাজ করা হয়। 

প্রথমদিকে জমজম কূপ কেবল বালি ও পাথর দ্বারা ঘেরা ছিলো। 

৭৭১ সালে আব্বাসীয় খলিফা আল মনসুরের সময় এর গম্বুজ এবং মার্বেল টাইলস লাগানো হয়। 

৭৭৫ সালে খলিফা আল মাহদি সেগুন কাঠের গম্বুজ দ্বারা সংস্কার করেন।

৮৩৫ সালে খলিফা মুহতাসিম বিল্লাহ গম্বুজটি মার্বেল পাথর দ্বারা প্রতিস্থাপন করেন। 

১৪১৭ সালে মামলুকদের সময়ে গম্বুজটি আগুনে ধ্বংস হয়ে যায়।

১৯১৫ সালে ওসমানিয় সুলতান আব্দুল হামিদ জমজম কূপের আধুনিকায়ন করেন। তিনি জমজম কূপের কাছে অবস্থিত সব বাড়ি-ঘর সরিয়ে তাওয়াফ করার স্থানের বাইরে নিয়ে যান। 

সৌদি রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা বাদশাহ আবদুল আজিজ বিন সউদের সময় জমজম কূপের দক্ষিণ এবং পূর্ব দিকে পানির কল বসানো হয়।

সর্বশেষ ২০১৭ এবং ২০১৮ সালে সৌদি বাদশাহ জমজম কূপের সংস্কার করেন।

বর্তমানে জমজম কূপ ভূগর্ভস্থ অবস্থায় বা বেসমেন্ট এ রাখা হয়েছে। এখান থেকে পাম্পের সাহায্যে পানি উত্তোলন করা হয় এবং মসজিদুল হারামের বিভিন্ন স্থানে তা সরবরাহ করা হয়।

জমজম কূপের গুরুত্ব এবং উপকারিতা

কাবা গৃহের ইতিহাস এবং জমজম কূপ একটি অন্যটির সাথে গুরুত্ব পূর্ন ভাবে জড়িত। জমজম কূপ পৃথিবীর সবচাইতে পবিত্রতম, বরকতময় কূপ। এর পানি পৃথিবীর সর্বোত্তম ও সুস্বাদু পানি। নিম্নে জমজম কূপের গুরুত্ব এবং উপকারিতা তুলে ধরা হলোঃ-

১. জমজমের পানি শুধু তৃষ্ণা মেটায় না। সাথে ক্ষুধাও নিবারণ করে। হজরত আবু জর (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘জমজমের পানি বরকতময়, স্বাদ অন্বেষণকারীর খাদ্য’ (সহিহ মুসলিম: ২৪৭৩)। 

২.জমজম কূপের পানি যে নিয়তে বা নেক উদ্দেশ্যে পান করা হয় তা পূরণ হয়। জাবির (রা.) বর্ণিত হাদিসে রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘জমজমের পানি যে উদ্দেশ্য নিয়ে পান করবে তা পূরণ হবে। ’ (সুনানে ইবনে মাজাহ: ৩০৬২)

৩.রাসূলুল্লাহ (সা:)- এর  বক্ষ বিদীর্ণ করে জিবরাইল (:) জমজম কূপের পানি দিয়ে তা ধুয়ে দিয়েছিলেন (বুখারি-৩৩৪২)।

৫.আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজের সঙ্গে পাত্রে মশকে করে জমজমের পানি বহন করতেন। তা অসুস্থদের ওপর ছিটিয়ে দিতেন এবং তাদের পান করাতেন। (সুনানে তিরমিজি)
 
৬. সাধারণভাবে ইসলামি বিধান অনুযায়ী পানি বসে পান করতে হয়। কিন্তু জমজম কুপের পানির ক্ষেত্রে এ নিয়মের ব্যাতিক্রম রয়েছে।  জমজম কুপের পানি পান করার সময় কিবলার দিকে মুখ করে দাঁড়াবেন এবং আল্লাহর নাম নিয়ে তিন ঢোকে জমজমের পানি পান করবেন।  পান করার সময় নিম্নের দোয়াটি পাঠ করা-

  "হে আল্লাহ, আমি আপনার কাছে কল্যাণকর জ্ঞান, প্রসস্থ রিযিক এবং সকল ব্যাধি থেকে আরোগ্য প্রার্থনা করছি (দারা কুতনী-৪৬৬, আব্দুর রাজ্জাক হাকেম, বর্ণনায় ইবেনে আব্বাস)"

শেষ কথাঃ জমজম কূপের ইতিহাস, গুরুত্ব এবং উপকারিতা

আজকের আর্টিকেল থেকে আশা করি আমরা জমজম কূপের ইতিহাস, গুরুত্ব এবং উপকারিতা সম্পর্কে জানতে পেরেছি। আল্লাহ পাক আমাদের সবাইকে আল্লাহর পবিত্র ঘর কাবা শরিফ এবং জমজম কূপ দেখার তৌফিক দান করুন। আমিন।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url

এইটা একটি বিজ্ঞাপন এরিয়া। সিরিয়ালঃ ১

এইটা একটি বিজ্ঞাপন এরিয়া। সিরিয়ালঃ ২

এইটা একটি বিজ্ঞাপন এরিয়া। সিরিয়ালঃ ৩

এইটা একটি বিজ্ঞাপন এরিয়া। সিরিয়ালঃ ৪