মহাস্থানগড় । কোথায় অবস্থিত ও কেন বিখ্যাত?

পরিচিতিঃ মহাস্থানগড় । কোথায় অবস্থিত ও কেন বিখ্যাত?

বাংলাদেশের একটি অন্যতম প্রাচীন এবং বিখ্যাত পুরাকীর্তি হচ্ছে মহাস্থানগড়। ঐতিহাসিক এই মহাস্থানগড় নগরী  আজকের আমাদের আর্টিকেলের আলোচ্য বিষয় । আর্টিকেলটি পুরোটা পড়লে জানতে পারবেন মহাস্থানগড় কোথায় অবস্থিত ও কেন বিখ্যাত? 
তবে মহাস্থানগড় কোথায় অবস্থিত এবং কেন বিখ্যাত তা জানার পুর্বে এর পরিচয় এবং অতীত ইতিহাস নিয়ে কিছু আলোচনা করা দরকার।

মহাস্থানগড় পরিচয় এবং ইতিহাস

 আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে গোড়াপত্তন হয়েছিল মহাস্থানগড়ের। প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে গড়ে ওঠা প্রাচীন বাংলার এক জনপদের নাম ছিল পুণ্ড্র।
এই পুণ্ড্র  জনপদের রাজধানী হিসেবে গড়ে উঠেছিল  পুণ্ড্রবর্ধন বা পুণ্ড্রনগর।  প্রাচীন এই  পুণ্ড্রবর্ধন বা পুণ্ড্রনগরই বর্তমানে  মহাস্থানগড় নামে পরিচিত। ভারতীয় উপমহাদেশের বিস্তির্ণ এলাকা ছিলো এই রাজ্যের আওতায়। 

মহাস্থানগড়ের ইতিহাসঃ

 জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সহকারী অধ্যাপক জয়ন্ত সিংহ রায় এর ভাষ্য মতে, ‘‘এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত বাংলাদেশের সবচাইতে প্রাচীন রাজধানী শহর হচ্ছে মহাস্থানগড় ৷ এখানে প্রাক মৌর্য যুগ, মানে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগের  মানববসতির প্রমাণ পাওয়া যায়৷'' 
মহাস্থানগড় তথা পুণ্ড্রনগর মৌর্য গুপ্ত রাজবংশের রাজাদের হাত ধরে গড়ে উঠেছিল। তারপর পাল সেন বংশের রাজারা ধারাবাহিকভাবে এই অঞ্চলটিকে তাদের প্রাদেশিক রাজধানী হিসেবে শাসন করে আসছিল। খ্রিষ্টপূর্ব ৩য় শতাব্দী থেকে খ্রিষ্টীয় ১৫ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে এই নগর এক সমৃদ্ধ জনপদ হিসেবে বিস্তার লাভ করে। সে হিসেবে মহাস্থানগড় এর বয়স প্রায় আড়াই হাজার বছরেরও বেশি।
বিখ্যাত চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং ৬৩৯ থেকে ৬৪৫ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে পুন্ড্রনগরে এসেছিলেন। ভ্রমণের ধারাবিবরণীতে তিনি তখনকার প্রকৃতি জীবনযাত্রার উল্লেখ করে বর্ণনা দেন। তার ভ্রমণের ধারাবিবরণীতে এ নগরীকে "পুন-ন ফতন-ন" নামে বর্ণ্না করেন।  বৌদ্ধ শিক্ষার জন্য প্রসিদ্ধ হওয়ায় চীন-তিব্বত সহ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল বৌদ্ধ  ভিক্ষুরা তখন  মহাস্থানগড়ে আসতেন লেখাপড়া করতে ।

আবিস্কার ও খননঃ 

১৮০৮ খ্রিষ্টাব্দে ফ্রান্সিস বুকানন হ্যামিলটন প্রথম মহাস্থানগড়ের অবস্থান চিহ্নিত করেন। ১৮৭৯ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ প্রত্নতত্ত্ববিদ স্যার আলেকজান্ডার কানিংহাম প্রথম এই প্রাচীন ঐতিহাসিক নগরী মহাস্থানগড়কে হিউয়েন সাং বর্ণিত পুন্ড্র রাজ্যের  রাজধানী পুন্ড্রবর্ধন রূপে চিহ্নিত করেন। ১৯২৮-২৯ খ্রিস্টাব্দে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অভ ইন্ডিয়ার তৎকালীন মহাপরিচালক কাশীনাথ নারায়ণ দীক্ষিতের তত্ত্বাবধানে মহাস্থানগড়ের প্রথম প্রত্নতাত্ত্বিক খননকাজ আরম্ভ হয়।
                                 ১৯৩১ সালে এখানে প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ফলে ব্রাহ্মী লিপির সন্ধান মেলে, যাতে সম্রাট অশোক কর্তৃক দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষকে  রাজভান্ডার থেকে খাদ্যশস্য ও অর্থ সহায়তা দিয়ে সাহায্য করার জন্য "মহামাত্র" বা স্থানীয় শাসক তথা গভর্নরকে আদেশ প্রদানের তথ্য পাওয়া যায়।
  ২০১৬ সালে মহাস্থানগড় কে সার্ক কালচারাল সেন্টার কর্তৃক সার্কের "সাংস্কৃতিক রাজধানী" হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়।

মহাস্থানগড় কোথায় অবস্থিত

   বর্তমান বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলীয় বগুড়া শহর থেকে উত্তর দিকে ১৩ কিলোমিটার দূরে  শিবগঞ্জ উপজেলায় করতোয়া নদীর পশ্চিম তীরে ঢাকা-বগুড়া মহাসড়কের পাশে মহাস্থানগড় অবস্থিত।মহাস্থানগড় এলাকাটি পূর্ব  উত্তর দিকে করতোয়া নদীপশ্চিম দিকে কালি দহ সাগর নামক জলাশয় আর দক্ষিণ-পশ্চিমে বারনসি খাল দিয়ে বেষ্টিত

মহাস্থানগড় কেন বিখ্যাত 

মহাস্থানগড় এর ইতিহাস নিয়ে লিখিত ‘পুণ্ড্র’ নামক গবেষণা গ্রন্থে অধ্যাপক মোস্তফা আলী এবং ‘ইতিকথা-পৌণ্ড্রবর্ধন’   নামক বইয়ে অধ্যাপক মো. আব্দুল মান্নান বলেছেন, 'মহাস্থান' শব্দটির অর্থ বিখ্যাত স্থান বা জায়গা। স্থানটির নাম মহাস্থান হয়েছে বিখ্যাত স্নানের স্থান বা জায়গা থেকে।
 দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ শতাব্দির মাঝে কবি এবং পন্ডিত পরশুরাম রচিত সংস্কৃত কাব্য গ্রন্থ ‘করতোয়া মাহাত্ম্য’ এ  মহাস্থানকে তথা মহাস্থানগড়কে হিন্দু দেবতা বিষ্ণু দেবের স্থায়ী আবাসস্থল হিসেবে বর্ণিত হয়েছে।
নিম্নলিখিত স্থানগুলোর কারনে মহাস্থানগড় বিখ্যাতঃ
মাহী সওয়ার এর মাজার শরীফ:
হাস্থানগড় বাস স্ট্যান্ড থেকে কিছুটা পশ্চিমে একটি ঐতিহাসিক মাজার শরীফ রয়েছে। পীরজাদা হযরত শাহ সুলতান মাহমুদ বলখী (র:) সমাধিকে কেন্দ্র করে প্রাচীন এই মাজার শরীফটি গড়ে উঠেছে। তার মাধ্যমে অত্র অঞ্চলে মুসলিম শাসনের সুত্রপাত হয়। আশপাশের অঞ্চল থেকে এটি অপেক্ষাকৃত উচু বিধায় একে গড় বলা হয়
কালীদহ সাগর:
মহাস্থানগড়ের পশ্চিম অংশে রয়েছে ঐতিহাসিক কালীদহ সাগর এবং পদ্মাদেবীর বাসভবন। কালীদহ সাগর সংলগ্ন ঐতিহাসিক গড় জড়িপা নামক একটি মাটির দূর্গ রয়েছে। প্রাচীন এই কালীদহ সাগরে প্রতিবছরের মার্চ মাসে হিন্দু ধর্মালম্বীদের  বারুন্নী স্নান অনুষ্ঠিত হয়। স্নান শেষে পুণ্যার্থীগণ সাগরপাড়ে গঙ্গাপূজা ও সংকীর্তন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন।
শীলাদেবীর ঘাট:
মহাস্থানগড়ের পূর্ব পাশে  করতোয়া নদী এর তীরে 
রয়েছে ‘শীলাদেবীর ঘাট’। প্রচলিত কথা অনুযায়ি,  শীলাদেবী ছিলেন পরশুরামের বোন। রাজা পরশুরাম হযরত শাহ সুলতান মাহমুদ বলখী (র)-এর কাছে পরাজিত হলে শীলাদেবী এ স্থানে আত্মাহুতি দেন। এখানে প্রতি বছর হিন্দুদের স্নান হয় এবং একদিনের একটি মেলা বসে।
জিউৎকুন্ড কুপ:
মহাস্থান গড়ের শীলাদেবীর ঘাটের  পশ্চিমে জিউৎকুন্ড নামে একটি বড় কুপ আছে। কথিত আছে এই কুপের পানি পান করে পরশুরামের আহত সৈন্যরা সুস্থ হয়ে যেত। যদিও এর কোন ঐতিহাসিক ভিত্তি পাওয়া যায়নি।
বেহুলার বাসর ঘর:
মহাস্থানগড় বাস স্ট্যান্ড থেকে প্রায় ২কি.মি দক্ষিণ পশ্চিমে একটি বৌদ্ধ স্তম্ভ রয়েছে যা সম্রাট অশোক নির্মাণ করেছিলেন বলে মনে করা হয়। স্তম্ভের উচ্চতা প্রায় ৪৫ ফুট। স্তম্ভের পূর্বার্ধে রয়েছে ২৪ কোণ বিশিষ্ট চৌবাচ্চা সদৃশ একটি স্নানাগার । স্থানীয়ভাবে এটি বেহুলার বাসর ঘর নামেই পরিচিত।
গোবিন্দ ভিটা:
মহাস্থানগড় জাদুঘরের ঠিক সামনেই গোবিন্দ ভিটা অবস্থিত। গোবিন্দ ভিটা একটি খননকৃত প্রত্নস্থল। গোবিন্দ ভিটা শব্দের অর্থ  হিন্দু দেবতা গোবিন্দ তথা বিষ্ণুর আবাস। যদিও বৈষ্ণব ধর্মের কোনো নিদর্শন এখানে  ্মেলেনি তবুও এটি  'গোবিন্দ ভিটা' নামেই পরিচিত।
ভাসু বিহার:
ভাসু বিহার 
মহাস্থানগড় তথা বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন নিদর্শন। মহাস্থানগড় থেকে ৬ কিলোমিটার পশ্চিমে বিহার ইউনিয়নের ভাসু বিহার নামক গ্রামে অবস্থিত। স্থানীয়রা একে 'নরপতির ধাপ' হিসেবে চেনে। ধারণা করা হয়, এটি একটি সংঘারামের ধ্বংসাবশেষ। 
 চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং  তার মহাস্থানগড় এর ধারাবিবরণে একে "পো-সি-পো" নামে উল্লেখ করেন। স্যার আলেকজান্ডার কানিংহাম প্রমান করেন যে এটি হিউয়েন সাং বর্ণিত সেই বৌদ্ধবিহারেরই ধ্বংসাবশেষ।
জাদুঘর:
মহাস্থানগড় খননের ফলে মৌর্য, গুপ্ত, পাল ও সেন যুগের বিভিন্ন দ্রব্যাদিসহ অনেক দেবদেবীর মূর্তি পাওয়া গেছে যা মহাস্থানগড়ের উত্তরে অবস্থিত জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। মহাস্থানগড় ছাড়াও আরও বিভিন্ন স্থানের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন এখানে সংরক্ষিত আছে।

শেষ কথা । মহাস্থানগড় কোথায় অবস্থিত ও কেন বিখ্যাত?

মহাস্থানগড় বাংলাদেশের এক অন্যতম প্রাচীন এবং গুরূত্বপুর্ণ প্রত্নতাত্বিক নিদর্শন। আশা করা যায়, খুব শীঘ্রই  মহাস্থানগড় "ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট" বা "বিশ্ব ঐতিহ্য" হিসেবে স্বীকৃতি পাবে। আজকের আর্টিকেল পড়ে নিশ্চই আপনারা মহাস্থানগড় সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পেরেছেন। যদি আর্টিকেলটি আপনাদের ভালো লেগে থাকে তবে  শেয়ার করুন আপনাদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। আর কোন কিছু জানতে হলে বা কোন মতামত থাকলে জানান কমেন্ট সেকশনে।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url

এইটা একটি বিজ্ঞাপন এরিয়া। সিরিয়ালঃ ১

এইটা একটি বিজ্ঞাপন এরিয়া। সিরিয়ালঃ ২

এইটা একটি বিজ্ঞাপন এরিয়া। সিরিয়ালঃ ৩

এইটা একটি বিজ্ঞাপন এরিয়া। সিরিয়ালঃ ৪